Sunday, December 16, 2012

অস্বচ্ছতায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

ঢালিউড ইনফো:: বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জুরিবোর্ড সদস্যদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে চলচ্চিত্রাঙ্গনসহ বিভিন্ন মহল। সবার মতে জাতীয় শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্যেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রভাব এবং পক্ষপাতিত্বের কারণে সেই লক্ষ্য বরাবরই
ব্যাহত হচ্ছে।

১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর থেকেই এতে নানা প্রভাব ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থাকলেও বিষয়টি জোরালো হয় ২০১০ ও ২০১১ সালে অভিনেতা আলমগীরের পুরস্কার পাওয়াকে কেন্দ্র করে। ও িবছর আলমগীর জুরিবোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, জুরিবোর্ডের সদস্যরা পুরস্কার নিতে পারবে না এমন কোনো নীতিমালা না থাকলেও নৈতিকভাবে কোনো সদস্যের এই পুরস্কার নেওয়া উচিত নয়। নিলে জুরিবোর্ডসহ সরকার বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হয়। সন্দেহ ও বিতর্ক দেখা দেয়। বাস্তবে ২০১০ ও ২০১১ সালে সেটিই হয়েছে। ২০১০ সালে আলমগীর শ্রেষ্ঠ পাশর্্ব অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান 'জীবন মরণের সাথী' চলচ্চিত্রের জন্য। ওই সময়ও তিনি জুরিবোর্ডের সদস্য ছিলেন। ২০১১ সালেও জুরিবোর্ডের সদস্য থাকা অবস্থায় আবারও তিনি পাশর্্ব অভিনেতার পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন 'কে আপন কে পর' চলচ্চিত্রের জন্য। আলমগীরের পুরস্কার পাওয়া নিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গনে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, এবার 'খণ্ড গল্প' নামে একটি চলচ্চিত্রের জন্য সুবর্ণা মুস্তাফাকে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করা হলে জুরিবোর্ডের সদস্য হওয়ায় সুবর্ণা নিজেই পুরস্কার গ্রহণে অসম্মতি জানান এবং তার আপত্তির ফলে সুপারিশ প্রত্যাহার করা হয়।


সূত্র জানায়, এটি নৈতিকতা বজায়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যা আলমগীর করেননি। সূত্রটি জানায়, জুরিবোর্ডের সদস্য কারা হবে এ ব্যাপারে সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকার প্রয়োজন ছিল। কারণ, চলচ্চিত্র পুরস্কারের ক্ষেত্রে যদি চলচ্চিত্রের লোকজনকেই জুরিবোর্ডের সদস্য করা হয় তাহলে পুরস্কারের জন্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকে না, যা চলে আসছে। জুরিবোর্ডের সদস্য হতে হবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত নন অথচ চলচ্চিত্র সম্পর্কে জ্ঞানচর্চা আছে এমন ব্যক্তিত্বদের। তারা হতে পারেন শিক্ষাঙ্গনের মিডিয়া বিভাগের শিক্ষক এবং চলচ্চিত্র গবেষক।

সূত্র জানায়, পুরস্কারের জন্য নির্বাচন নিয়ে প্রতিবারই সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। রীতিমতো এক্ষেত্রে তর্কাতর্কি ও বাহাস চলে। এবারও তাই হয়েছে। দলীয় এবং চলচ্চিত্রাঙ্গনের প্রভাব, চাপ, আবদার, অনুরোধ ইত্যাদি কারণে সঠিকভাবে পুরস্কারের নির্বাচন হয় না। সূত্রমতে, এবার শ্রেষ্ঠ পাশর্্ব অভিনেতার পুরস্কারটি দেওয়ার জন্য 'আমার বন্ধু রাশেদ' চলচ্চিত্রের অভিনয় শিল্পী রায়হান ইফতেসাম চৌধুরীর নাম সুপারিশ করা হলেও শেষ পর্যন্ত আবদার ও চাপের মুখে অভিনেতা আলমগীরকে এই পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়। জাতীয় পুরস্কার নিয়ে এ ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। শুরু থেকে অনৈতিকতা চলে আসছে। ১৯৭৮ সালে জুরিবোর্ড শ্রেষ্ঠ নায়ক হিসেবে 'অশিক্ষিত' চলচ্চিত্রের জন্য নায়করাজ রাজ্জাকের নাম সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশমালা জমা দিলেও পরে সরকারের পক্ষ থেকে দলীয় প্রীতির কারণে রাজ্জাকের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ নায়ক হিসেবে 'বধূ বিদায়' চলচ্চিত্রের জন্য বুলবুল আহমেদের নাম জুড়ে দেওয়া হয়। অথচ জুরিবোর্ডের সুপারিশ তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার পর এতে সরকারপ্রধানের স্বাক্ষর ছাড়া আর কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজনের নিয়ম সংশ্লিষ্ট নীতিমালায় নেই। সূত্র জানায়, এ ধরনের অন্যায় হস্তক্ষেপের কাছে সম্মান হারাচ্ছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সূত্র আরও জানায়, ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা দেওয়ার জন্য চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্তের নাম এসেছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান ছিল। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসণের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে তিনি নির্মাণ করেছিলেন চলচ্চিত্র 'অরুণোদয়ের অগি্নসাক্ষী'। এ ছাড়াও সুভাষ দত্ত 'সুতরাং' চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করে প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য বিদেশ থেকে পুরস্কার ও সম্মান বয়ে আনেন। কিন্তু নানা আপত্তির মুখে ১৪ নভেম্বর আজীবন সম্মাননা থেকে সুভাষ দত্তের নাম বাদ দেওয়া হয়। এর দুদিনের মাথায় ১৬ নভেম্বর সুভাষ দত্ত মারা যান।

সূত্র জানায়, এবার পুরস্কারের জন্য ২৭টি চলচ্চিত্র জমা পড়ে। এর মধ্যে ২০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও সাতটি ছিল তথ্যচিত্র। ২০টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের মধ্যে মূল বিবেচনায় আনা হয়েছিল চারটি চলচ্চিত্রকে। এগুলো হলো_ গেরিলা, আমার বন্ধু রাশেদ, মধুমতি এবং খণ্ডগল্প। এর মধ্যে 'মধুমতি' চলচ্চিত্রটির গল্প অসাধারণ হলেও নির্মাণ মানসম্মত না হওয়ায় এটি কোনো শাখায়ই মনোনয়ন পায়নি। কিন্তু 'আমার বন্ধু রাশেদ' এবং 'খণ্ডগল্প'র কাহিনী, নির্মাণ, অভিনয় সব দিক দিয়ে অনবদ্য হওয়ার পরেও অনৈতিক চাপের মুখে চলচ্চিত্র দুটিকে স্বীকৃতি থেকে দূরে রাখা হয়। অথচ খণ্ডগল্পের জন্য পাশর্্ব অভিনেত্রী হিসেবে ওয়াহিদা মলি্লক জলি প্রায় চূড়ান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত তাকে বাদ দেওয়া হয়।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে নকল চলচ্চিত্রকে পুরস্কার দেওয়ার সুপারিশের অভিযোগও আনে সূত্র। শাহীন সুমন পরিচালিত 'কে আপন কে পর' চলচ্চিত্রটি নব্বই দশকে বলিউডে নির্মিত শাওন কুমার পরিচালিত 'স্বর্গ' এবং পশ্চিমবঙ্গে একই দশকে রবি কিনাগী নির্মিত 'অন্নদাতা' চলচ্চিত্রের নকল বলে সূত্রটি জানায়। 'স্বর্গ' চলচ্চিত্রে রাজেশ খান্না ও গোবিন্দ এবং 'অন্নদাতা'তে রাজ্জাক এবং প্রসেনজিৎ অভিনয় করেন। এ দুটি চলচ্চিত্রের নকল 'কে আপন কে পর'-এ এসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলমগীর ও অমিত হাসান। এই নকল চলচ্চিত্রের জন্যই পুরস্কার পাচ্ছেন আলমগীর। আগেও নকল ও বাঙালি সংস্কৃতি পরিপন্থী চলচ্চিত্রকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়ার নজির রয়েছে বলে জানায় সূত্র। অথচ আশির দশকে চাষী নজরুল ইসলামের 'দেবদাস' চলচ্চিত্রটিকে বলিউডে নির্মিত বিমল রায়ের 'দেবদাস'র রিমেক আখ্যা দিয়ে জাতীয় পুরস্কার থেকে দূরে রাখা হয়েছিল।

সূত্র জানায়, পুরস্কারের জন্য গঠিত জুরিবোর্ডের মেয়াদ এক বছরের বেশি হওয়া উচিত নয়। এতে দুর্নীতি বাড়ার সুযোগ থাকে। ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য গঠিত জুরিবোর্ডের সদস্যরা হলেন_ উপসচিব (তথ্য মন্ত্রণালয়), অভিনয়শিল্পী ফারুক, আলমগীর, সুবর্ণা মুস্তাফা, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব আবদুল লতিফ বাচ্চু, মহিউদ্দিন ফারুক, সংগীতশিল্পী সাদী মহাম্মদ এবং চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এম হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন।

No comments:

Post a Comment